Dhaka 7:01 am, Saturday, 14 June 2025
[gtranslate]

কম্বোডিয়ায় কাজের সুযোগ: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ

বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে বৈচিত্র্যতা এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কম্বোডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কৃষি, পোশাকশিল্প, পর্যটন ও নির্মাণ খাতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে দেশটি কর্মসংস্থানের জন্য একটি নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক কর্মজীবী মানুষ কাজের খোঁজে কম্বোডিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই রচনায় আমরা কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারের গঠন, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করব।

১. কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারের প্রেক্ষাপট

কম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাত অত্যন্ত উচ্চ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমবাজারের একটি বড় অংশ কৃষিনির্ভর হলেও শহরাঞ্চলে পোশাক শিল্প এবং নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্যটন খাতও একটি বড় নিয়োগকর্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০১০ সালের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ অনেক বেড়েছে। দেশটির রপ্তানি আয়ের একটি বিশাল অংশ আসে পোশাক ও টেক্সটাইল খাত থেকে, যেখানে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন।

এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন ভিত্তিক বিনিয়োগকারীরা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন, যা স্থানীয় এবং বিদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স ও লজিস্টিক খাতেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এইসব উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির অভাব ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

২. বিদেশিদের জন্য কাজের ক্ষেত্রসমূহ

কম্বোডিয়ায় বিদেশিদের জন্য যেসব খাতে কাজের সুযোগ বেশি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • নির্মাণ খাত: বড় বড় আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পে দক্ষ শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রয়োজন হয়। বিদেশি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো চীনা, দক্ষিণ কোরীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে।
  • শিক্ষা খাত: ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় এবং বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষকতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। TESOL বা CELTA সার্টিফিকেটধারী শিক্ষকরা এখানে সহজেই চাকরি পেয়ে থাকেন।
  • হোটেল ও পর্যটন শিল্প: বিশ্বমানের হোটেল চেইন এবং স্থানীয় হসপিটালিটি সেক্টর কর্মী নিয়োগ করছে—বিশেষ করে কুক, বেকার, হাউসকিপিং সুপারভাইজার এবং গেস্ট রিলেশন অফিসার পদে।
  • তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবা: সিস্টেম অ্যানালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনার এবং গ্রাফিক ডিজাইনারদের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। অনেক আন্তর্জাতিক আইটি কোম্পানি ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ দিচ্ছে।

৩. বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা

বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মী কম্বোডিয়ায় যেতে আগ্রহী। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, নির্মাণ খাত এবং রেস্তোরাঁ বা হোটেল শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রতিযোগিতামূলক বেতন এবং কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। কম্বোডিয়ার শ্রম বাজারে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার কারণগুলো:

  • জনশক্তির প্রাচুর্য: বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষাধিক যুবক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যাদের একটি অংশ বিদেশে কাজ করতে আগ্রহী।
  • ভাষাগত নমনীয়তা: ইংরেজিতে কাজ চালাতে সক্ষম হওয়ায় যোগাযোগ সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা মালিক ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
  • কম খরচে অভিবাসন: মালয়েশিয়া, সৌদি আরব বা ইউরোপের তুলনায় কম্বোডিয়ায় যাওয়ার খরচ তুলনামূলকভাবে কম।
  • পেশাগত অভিজ্ঞতা: পোশাক শিল্প, হোটেল ও কনস্ট্রাকশন খাতে বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা কম্বোডিয়ার চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

৪. প্রবাসী কর্মীদের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশি কর্মীদের একটি বড় অংশ কম্বোডিয়ায় ইতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। অনেকে ব্যবসা শুরু করেছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের মতে, যথাযথ নিয়ম মেনে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

তবে অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রিত রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া, দালালদের প্রতারণা এবং ভাষা-সংস্কৃতি বুঝে উঠতে না পারার কারণে অনেকেই কর্মজীবনে হতাশ হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পাসপোর্ট আটকে রাখা, অতিরিক্ত কাজ করানো এবং নির্ধারিত বেতন না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

বিশেষ একটি ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে: ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম থেকে ১৭ জন যুবক কম্বোডিয়ার পোশাক খাতে কাজ করতে যান। তারা প্রতিশ্রুত বেতনের চেয়ে কম বেতন পান এবং দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় তারা আইনি সহায়তা পাননি। পরে একটি এনজিওর সহায়তায় তারা দেশে ফিরে আসেন। এ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে সুসংগঠিত অভিবাসন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি।

৫. আইনি কাঠামো ও ভিসা নীতিমালা

কম্বোডিয়ায় বৈধভাবে কাজ করতে হলে একটি উপযুক্ত ওয়ার্ক পারমিট, বাণিজ্যিক ভিসা (E-class) এবং নিয়োগকর্তার অনুমোদন প্রয়োজন। প্রথমে ৩০ দিনের ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে পরে তা এক বছর মেয়াদি এক্সটেনশন করা যায়।

ভিসা নীতিমালার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো E-class ভিসার ধরন অনুযায়ী কয়েকটি সাব-টাইপ, যেমন EB (বিজনেস), EG (জেনারেল), EP (প্রি-ওয়ার্ক) ইত্যাদি, যা অনেক বিদেশি ও এজেন্টরাও ঠিকভাবে বোঝেন না। ফলে বিভ্রান্তি এবং অতিরিক্ত খরচ হয়।

শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক নিয়োগকর্তাকে বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কাজ শুরুর ১৫ দিনের মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ে নথিভুক্ত করতে হয়। তবে অনেক কোম্পানি তা না করে অবৈধভাবে বিদেশি নিয়োগ দেয়, যার ফলে শ্রমিকরা আইনি সুরক্ষা হারায়।

বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো—কম্বোডিয়ার সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি নেই। ফলে ভিসা সংক্রান্ত সহায়তা, শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি এবং দূতাবাসের মাধ্যমে হস্তক্ষেপের সুযোগ সীমিত। উপরন্তু, প্রশাসনিক দুর্নীতি, ভিসা রিনিউয়ালের অনিয়ম ও অতিরিক্ত ফি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে।

৬. চ্যালেঞ্জসমূহ

কম্বোডিয়ায় কাজ করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো হলো:

  • ভাষাগত বাধা: খমের ভাষা না জানলে স্থানীয় সহকর্মী ও গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা হয়।
  • সংস্কৃতিগত পার্থক্য: অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কম্বোডিয়ার খাবার, পোশাক ও ধর্মীয় আচার আচরণে অভ্যস্ত নন।
  • শ্রম অধিকার হরণ: অনেকে ছুটি, ওভারটাইম বা স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
  • নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: নির্মাণ সাইট বা রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামের অভাব এবং দূষণ বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয়।
  • দূতাবাসের অনুপস্থিতি: বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় প্রবাসীদের আইনি সহায়তা পেতে জটিলতা হয়।

৭. অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে কম্বোডিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩% পর্যন্ত হতে পারে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে। পোশাক শিল্পে চীন ও ভিয়েতনামের বিকল্প হিসেবে কম্বোডিয়ার স্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একই সঙ্গে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি যেমন RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) এবং চীনের Belt and Road Initiative-এর অংশগ্রহণ কম্বোডিয়ার অবকাঠামো ও শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। এতে করে দেশটির শ্রমবাজারে বিদেশিদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে ভবিষ্যৎ শ্রম বাজারে চাহিদা পরিবর্তন হবে। অটোমেশন ও প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ার ফলে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীদের যদি প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ভাষাজ্ঞান ও আইনগত সচেতনতা না থাকে, তবে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

৮. বাংলাদেশের করণীয়

বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

  • দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি স্বাক্ষর করা: কম্বোডিয়ার সঙ্গে সরকারিভাবে একটি শ্রমচুক্তি হলে কর্মীদের অধিকার রক্ষা সহজ হবে।
  • প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা: কম্বোডিয়ার চাহিদার ভিত্তিতে ট্রেড ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া।
  • বিশ্বস্ত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা প্রস্তুত করা: যাতে দালাল ও ভুয়া এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণা বন্ধ হয়।
  • কম্বোডিয়ায় দূতাবাসের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা: প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কনসুলার পরিষেবা জোরদার করা।
  • আইনগত সহায়তা ফান্ড গঠন করা: বিদেশে সমস্যায় পড়া কর্মীদের জন্য জরুরি সহায়তা তহবিল স্থাপন করা।

৯. ক্ষেত্রভিত্তিক কেস স্টাডি: সফল বাংলাদেশি প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা

এই অধ্যায়ে আমরা ৩টি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরব, যেগুলোর মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবন ও কর্মপরিবেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

কেস স্টাডি ১: মোহাম্মদ আলী, পোশাক কারখানার সুপারভাইজার মোহাম্মদ আলী ২০১৮ সালে কম্বোডিয়ার ফনোম পেন শহরে একটি আন্তর্জাতিক গার্মেন্টস কারখানায় কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশে তার ৭ বছরের অভিজ্ঞতা থাকায় সহজেই সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত হন। তার মাসিক বেতন ৬৫০ ডলার, যা স্থানীয়দের তুলনায় বেশি। কাজের পরিবেশ ভালো হলেও শুরুতে ভাষাগত সমস্যা ছিল। খমের ভাষা শিখে তিনি সহজেই মানিয়ে নেন।

কেস স্টাডি ২: সালমা আক্তার, হোটেল ম্যানেজার সালমা আক্তার বাংলাদেশ থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিপ্লোমা নিয়ে ২০২০ সালে কম্বোডিয়ায় যান। বর্তমানে তিনি সিয়েম রিপ শহরের একটি থ্রি-স্টার হোটেলের অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে পারদর্শিতা তাকে সফল করেছে। তিনি স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

কেস স্টাডি ৩: মুনির হাসান, ফ্রিল্যান্স আইটি বিশেষজ্ঞ মুনির হাসান একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার যিনি প্রথমে ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ক্লায়েন্টদের পরামর্শে তিনি ফনোম পেনে একটি কো-ওয়ার্কিং স্পেসে অফিস নেন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের জন্য ওয়েব অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট করছেন। কম খরচে জীবনযাপন এবং ডিজিটাল ভিসার সহজলভ্যতাই তাকে কম্বোডিয়া বেছে নিতে সহায়ক হয়েছে।

১০. শ্রমনীতি ও শ্রমিক অধিকার: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

কম্বোডিয়ার শ্রম আইন ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয়, যা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা এবং সংগঠনের অধিকার দেয়। তবে বাস্তবে অনেক নিয়োগকর্তা এসব আইন মানে না। বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কাজের অনুমোদন এবং ওয়ার্ক পারমিট বাধ্যতামূলক হলেও নিয়োগকর্তারা তা অনেক সময় এড়িয়ে যান।

তুলনা:

  • মালয়েশিয়া: এখানে শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা, ওয়ার্ক ভিসা, সুরক্ষিত থাকার জায়গা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
  • ভিয়েতনাম: বিদেশি শ্রমিকদের জন্য মাসিক ট্যাক্স, কাজের চুক্তির স্বচ্ছতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

কম্বোডিয়ার বাস্তবতা: ন্যূনতম মজুরি পোশাক শিল্পে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ ডলার হলেও অন্যান্য খাতে এর সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই। ওভারটাইম পাওনা এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য একটি মজবুত চুক্তি ও শ্রম অধিকার কাঠামো অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর (ILO, UN Migration) সহায়তা নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক চুক্তি স্বাক্ষর হলে উভয় দেশই উপকৃত হবে।

১১. প্রযুক্তির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ চাকরির ধরন

বিশ্বব্যাপী Fourth Industrial Revolution বা Industry 4.0-এর প্রভাবে কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারেও ধীরে ধীরে প্রযুক্তির প্রভাব বাড়ছে। বিশেষ করে উৎপাদন, লজিস্টিকস, এবং গ্রাহকসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার শ্রমের ধরন পাল্টে দিচ্ছে।

প্রভাব:

  • লাইন-প্রডাকশন বা কারখানার কাজগুলোতে রোবট এবং অটোমেশন বাড়ছে।
  • চাহিদা বাড়ছে আইটি, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ও অনলাইন মার্কেটিং-এর মতো কাজে।

বাংলাদেশের প্রস্তুতি:

  • এখন থেকেই স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করা দরকার।
  • কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউটের অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা উচিত।

কম দক্ষ শ্রমিকদের জন্য প্রযুক্তি-নির্ভর ভবিষ্যৎ একটি বড় হুমকি হতে পারে, যদি তারা রি-স্কিলিং বা আপ-স্কিলিংয়ের সুযোগ না পান।

১২. উপসংহার

কম্বোডিয়া এখনো এক নবউদীয়মান শ্রমবাজার, যেখানে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে সম্ভাবনার দরজা। তবে চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করা না গেলে এই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। রাষ্ট্র, রিক্রুটিং সংস্থা, এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং মানবিক অভিবাসন কাঠামো গড়ে তুললে কম্বোডিয়া বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

কম্বোডিয়ায় কাজের সুযোগ: সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ

Update Time : 12:09:18 am, Tuesday, 27 May 2025

বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে বৈচিত্র্যতা এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কম্বোডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কৃষি, পোশাকশিল্প, পর্যটন ও নির্মাণ খাতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে দেশটি কর্মসংস্থানের জন্য একটি নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক কর্মজীবী মানুষ কাজের খোঁজে কম্বোডিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। এই রচনায় আমরা কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারের গঠন, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করব।

১. কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারের প্রেক্ষাপট

কম্বোডিয়ার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাত অত্যন্ত উচ্চ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমবাজারের একটি বড় অংশ কৃষিনির্ভর হলেও শহরাঞ্চলে পোশাক শিল্প এবং নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্যটন খাতও একটি বড় নিয়োগকর্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০১০ সালের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ অনেক বেড়েছে। দেশটির রপ্তানি আয়ের একটি বিশাল অংশ আসে পোশাক ও টেক্সটাইল খাত থেকে, যেখানে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন।

এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন ভিত্তিক বিনিয়োগকারীরা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন, যা স্থানীয় এবং বিদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স ও লজিস্টিক খাতেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এইসব উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির অভাব ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

২. বিদেশিদের জন্য কাজের ক্ষেত্রসমূহ

কম্বোডিয়ায় বিদেশিদের জন্য যেসব খাতে কাজের সুযোগ বেশি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • নির্মাণ খাত: বড় বড় আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পে দক্ষ শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রয়োজন হয়। বিদেশি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো চীনা, দক্ষিণ কোরীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে।
  • শিক্ষা খাত: ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় এবং বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষকতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। TESOL বা CELTA সার্টিফিকেটধারী শিক্ষকরা এখানে সহজেই চাকরি পেয়ে থাকেন।
  • হোটেল ও পর্যটন শিল্প: বিশ্বমানের হোটেল চেইন এবং স্থানীয় হসপিটালিটি সেক্টর কর্মী নিয়োগ করছে—বিশেষ করে কুক, বেকার, হাউসকিপিং সুপারভাইজার এবং গেস্ট রিলেশন অফিসার পদে।
  • তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবা: সিস্টেম অ্যানালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনার এবং গ্রাফিক ডিজাইনারদের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। অনেক আন্তর্জাতিক আইটি কোম্পানি ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ দিচ্ছে।

৩. বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা

বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মী কম্বোডিয়ায় যেতে আগ্রহী। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, নির্মাণ খাত এবং রেস্তোরাঁ বা হোটেল শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রতিযোগিতামূলক বেতন এবং কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। কম্বোডিয়ার শ্রম বাজারে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার কারণগুলো:

  • জনশক্তির প্রাচুর্য: বাংলাদেশে প্রতিবছর লক্ষাধিক যুবক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যাদের একটি অংশ বিদেশে কাজ করতে আগ্রহী।
  • ভাষাগত নমনীয়তা: ইংরেজিতে কাজ চালাতে সক্ষম হওয়ায় যোগাযোগ সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা মালিক ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
  • কম খরচে অভিবাসন: মালয়েশিয়া, সৌদি আরব বা ইউরোপের তুলনায় কম্বোডিয়ায় যাওয়ার খরচ তুলনামূলকভাবে কম।
  • পেশাগত অভিজ্ঞতা: পোশাক শিল্প, হোটেল ও কনস্ট্রাকশন খাতে বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা কম্বোডিয়ার চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

৪. প্রবাসী কর্মীদের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশি কর্মীদের একটি বড় অংশ কম্বোডিয়ায় ইতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। অনেকে ব্যবসা শুরু করেছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের মতে, যথাযথ নিয়ম মেনে এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

তবে অন্যদিকে, অনিয়ন্ত্রিত রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া, দালালদের প্রতারণা এবং ভাষা-সংস্কৃতি বুঝে উঠতে না পারার কারণে অনেকেই কর্মজীবনে হতাশ হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পাসপোর্ট আটকে রাখা, অতিরিক্ত কাজ করানো এবং নির্ধারিত বেতন না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

বিশেষ একটি ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে: ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার একটি গ্রাম থেকে ১৭ জন যুবক কম্বোডিয়ার পোশাক খাতে কাজ করতে যান। তারা প্রতিশ্রুত বেতনের চেয়ে কম বেতন পান এবং দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় তারা আইনি সহায়তা পাননি। পরে একটি এনজিওর সহায়তায় তারা দেশে ফিরে আসেন। এ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে সুসংগঠিত অভিবাসন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি।

৫. আইনি কাঠামো ও ভিসা নীতিমালা

কম্বোডিয়ায় বৈধভাবে কাজ করতে হলে একটি উপযুক্ত ওয়ার্ক পারমিট, বাণিজ্যিক ভিসা (E-class) এবং নিয়োগকর্তার অনুমোদন প্রয়োজন। প্রথমে ৩০ দিনের ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে পরে তা এক বছর মেয়াদি এক্সটেনশন করা যায়।

ভিসা নীতিমালার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো E-class ভিসার ধরন অনুযায়ী কয়েকটি সাব-টাইপ, যেমন EB (বিজনেস), EG (জেনারেল), EP (প্রি-ওয়ার্ক) ইত্যাদি, যা অনেক বিদেশি ও এজেন্টরাও ঠিকভাবে বোঝেন না। ফলে বিভ্রান্তি এবং অতিরিক্ত খরচ হয়।

শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক নিয়োগকর্তাকে বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কাজ শুরুর ১৫ দিনের মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ে নথিভুক্ত করতে হয়। তবে অনেক কোম্পানি তা না করে অবৈধভাবে বিদেশি নিয়োগ দেয়, যার ফলে শ্রমিকরা আইনি সুরক্ষা হারায়।

বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো—কম্বোডিয়ার সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি নেই। ফলে ভিসা সংক্রান্ত সহায়তা, শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তি এবং দূতাবাসের মাধ্যমে হস্তক্ষেপের সুযোগ সীমিত। উপরন্তু, প্রশাসনিক দুর্নীতি, ভিসা রিনিউয়ালের অনিয়ম ও অতিরিক্ত ফি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে গেছে।

৬. চ্যালেঞ্জসমূহ

কম্বোডিয়ায় কাজ করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো হলো:

  • ভাষাগত বাধা: খমের ভাষা না জানলে স্থানীয় সহকর্মী ও গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা হয়।
  • সংস্কৃতিগত পার্থক্য: অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কম্বোডিয়ার খাবার, পোশাক ও ধর্মীয় আচার আচরণে অভ্যস্ত নন।
  • শ্রম অধিকার হরণ: অনেকে ছুটি, ওভারটাইম বা স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
  • নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: নির্মাণ সাইট বা রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তামূলক সরঞ্জামের অভাব এবং দূষণ বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয়।
  • দূতাবাসের অনুপস্থিতি: বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় প্রবাসীদের আইনি সহায়তা পেতে জটিলতা হয়।

৭. অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও প্রভাব

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে কম্বোডিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩% পর্যন্ত হতে পারে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে। পোশাক শিল্পে চীন ও ভিয়েতনামের বিকল্প হিসেবে কম্বোডিয়ার স্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একই সঙ্গে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি যেমন RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership) এবং চীনের Belt and Road Initiative-এর অংশগ্রহণ কম্বোডিয়ার অবকাঠামো ও শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। এতে করে দেশটির শ্রমবাজারে বিদেশিদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে ভবিষ্যৎ শ্রম বাজারে চাহিদা পরিবর্তন হবে। অটোমেশন ও প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ার ফলে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীদের যদি প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ভাষাজ্ঞান ও আইনগত সচেতনতা না থাকে, তবে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

৮. বাংলাদেশের করণীয়

বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

  • দ্বিপাক্ষিক শ্রমচুক্তি স্বাক্ষর করা: কম্বোডিয়ার সঙ্গে সরকারিভাবে একটি শ্রমচুক্তি হলে কর্মীদের অধিকার রক্ষা সহজ হবে।
  • প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা: কম্বোডিয়ার চাহিদার ভিত্তিতে ট্রেড ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া।
  • বিশ্বস্ত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা প্রস্তুত করা: যাতে দালাল ও ভুয়া এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণা বন্ধ হয়।
  • কম্বোডিয়ায় দূতাবাসের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা: প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য কনসুলার পরিষেবা জোরদার করা।
  • আইনগত সহায়তা ফান্ড গঠন করা: বিদেশে সমস্যায় পড়া কর্মীদের জন্য জরুরি সহায়তা তহবিল স্থাপন করা।

৯. ক্ষেত্রভিত্তিক কেস স্টাডি: সফল বাংলাদেশি প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা

এই অধ্যায়ে আমরা ৩টি বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরব, যেগুলোর মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবন ও কর্মপরিবেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

কেস স্টাডি ১: মোহাম্মদ আলী, পোশাক কারখানার সুপারভাইজার মোহাম্মদ আলী ২০১৮ সালে কম্বোডিয়ার ফনোম পেন শহরে একটি আন্তর্জাতিক গার্মেন্টস কারখানায় কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশে তার ৭ বছরের অভিজ্ঞতা থাকায় সহজেই সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত হন। তার মাসিক বেতন ৬৫০ ডলার, যা স্থানীয়দের তুলনায় বেশি। কাজের পরিবেশ ভালো হলেও শুরুতে ভাষাগত সমস্যা ছিল। খমের ভাষা শিখে তিনি সহজেই মানিয়ে নেন।

কেস স্টাডি ২: সালমা আক্তার, হোটেল ম্যানেজার সালমা আক্তার বাংলাদেশ থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিপ্লোমা নিয়ে ২০২০ সালে কম্বোডিয়ায় যান। বর্তমানে তিনি সিয়েম রিপ শহরের একটি থ্রি-স্টার হোটেলের অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে পারদর্শিতা তাকে সফল করেছে। তিনি স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

কেস স্টাডি ৩: মুনির হাসান, ফ্রিল্যান্স আইটি বিশেষজ্ঞ মুনির হাসান একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার যিনি প্রথমে ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ক্লায়েন্টদের পরামর্শে তিনি ফনোম পেনে একটি কো-ওয়ার্কিং স্পেসে অফিস নেন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের জন্য ওয়েব অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট করছেন। কম খরচে জীবনযাপন এবং ডিজিটাল ভিসার সহজলভ্যতাই তাকে কম্বোডিয়া বেছে নিতে সহায়ক হয়েছে।

১০. শ্রমনীতি ও শ্রমিক অধিকার: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

কম্বোডিয়ার শ্রম আইন ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয়, যা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা এবং সংগঠনের অধিকার দেয়। তবে বাস্তবে অনেক নিয়োগকর্তা এসব আইন মানে না। বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কাজের অনুমোদন এবং ওয়ার্ক পারমিট বাধ্যতামূলক হলেও নিয়োগকর্তারা তা অনেক সময় এড়িয়ে যান।

তুলনা:

  • মালয়েশিয়া: এখানে শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা, ওয়ার্ক ভিসা, সুরক্ষিত থাকার জায়গা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
  • ভিয়েতনাম: বিদেশি শ্রমিকদের জন্য মাসিক ট্যাক্স, কাজের চুক্তির স্বচ্ছতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

কম্বোডিয়ার বাস্তবতা: ন্যূনতম মজুরি পোশাক শিল্পে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ ডলার হলেও অন্যান্য খাতে এর সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই। ওভারটাইম পাওনা এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য একটি মজবুত চুক্তি ও শ্রম অধিকার কাঠামো অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর (ILO, UN Migration) সহায়তা নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক চুক্তি স্বাক্ষর হলে উভয় দেশই উপকৃত হবে।

১১. প্রযুক্তির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ চাকরির ধরন

বিশ্বব্যাপী Fourth Industrial Revolution বা Industry 4.0-এর প্রভাবে কম্বোডিয়ার শ্রমবাজারেও ধীরে ধীরে প্রযুক্তির প্রভাব বাড়ছে। বিশেষ করে উৎপাদন, লজিস্টিকস, এবং গ্রাহকসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার শ্রমের ধরন পাল্টে দিচ্ছে।

প্রভাব:

  • লাইন-প্রডাকশন বা কারখানার কাজগুলোতে রোবট এবং অটোমেশন বাড়ছে।
  • চাহিদা বাড়ছে আইটি, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ও অনলাইন মার্কেটিং-এর মতো কাজে।

বাংলাদেশের প্রস্তুতি:

  • এখন থেকেই স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করা দরকার।
  • কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউটের অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা উচিত।

কম দক্ষ শ্রমিকদের জন্য প্রযুক্তি-নির্ভর ভবিষ্যৎ একটি বড় হুমকি হতে পারে, যদি তারা রি-স্কিলিং বা আপ-স্কিলিংয়ের সুযোগ না পান।

১২. উপসংহার

কম্বোডিয়া এখনো এক নবউদীয়মান শ্রমবাজার, যেখানে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে সম্ভাবনার দরজা। তবে চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করা না গেলে এই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। রাষ্ট্র, রিক্রুটিং সংস্থা, এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং মানবিক অভিবাসন কাঠামো গড়ে তুললে কম্বোডিয়া বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।